রক্তে রাঙা শান্তিরক্ষা মিশন: সুদানে ড্রোন হামলায় ৬ বাংলাদেশি সেনা নিহত | Six Bangladeshi Peacekeepers Killed in Sudan Drone Attack
সুদানের দক্ষিণ কোরদোফান অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে ভয়াবহ ড্রোন হামলায় ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। এই হামলাকে ‘হররিফিক’ আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আন্তর্জাতিক মহলে শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও স্বাধীন তদন্তের দাবি।

রক্তে রাঙা শান্তিরক্ষা মিশন: সুদানে ড্রোন হামলায় ৬ বাংলাদেশি সেনা নিহত | Six Bangladeshi Peacekeepers Killed in Sudan Drone Attack - Ajker Bishshow
সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে নতুন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে চালানো ড্রোন হামলায় ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি এই হামলাকে “ভয়াবহ ও অমানবিক” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, শান্তিরক্ষীদের ওপর এমন আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ।
হামলার বিস্তারিত বিবরণ
ঘটনাটি ঘটে সুদানের দক্ষিণ কোরদোফান প্রদেশে অবস্থিত জাতিসংঘের ইউএনআইএসএফএ (UNISFA) মিশনের একটি লজিস্টিক ঘাঁটিতে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী, হঠাৎ করেই একটি সশস্ত্র ড্রোন আকাশপথে এসে শান্তিরক্ষীদের অবস্থানে বিস্ফোরক নিক্ষেপ করে। এতে ঘটনাস্থলেই ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হন এবং আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
নিহত ও আহত সবাই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী, যারা জাতিসংঘের পতাকাতলে শান্তি রক্ষা ও বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দ্রুত তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এই হামলাকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণগুলোর একটি বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন,
“এই নৃশংস ড্রোন হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করছেন, তাদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।
গুতেরেস নিহত শান্তিরক্ষীদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি সুদানে চলমান সংঘাত অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ সরকারের শোক ও প্রতিবাদ
বাংলাদেশ সরকার এই হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও গভীর শোক প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়,
“শান্তিরক্ষীদের ওপর এই বর্বর হামলা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত।”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিহতদের “দেশের গর্বিত সন্তান” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তিনি নিহতদের পরিবারকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন এবং আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আইএসপিআর জানায়, এই হামলা পরিকল্পিতভাবে শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল।
কারা এই হামলার জন্য দায়ী?
সুদানের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে এই হামলার জন্য দেশটির আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-কে দায়ী করা হয়েছে। যদিও আরএসএফ আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ড্রোন ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সুদানের গৃহযুদ্ধে আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে ড্রোনের ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও প্রাণঘাতী করে তুলছে।
সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধ: প্রেক্ষাপট
২০২৩ সাল থেকে সুদান ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। একদিকে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী, অন্যদিকে আরএসএফ—এই দুই শক্তির সংঘর্ষে দেশটি কার্যত ধ্বংসের মুখে।
এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত—
- লক্ষাধিক মানুষ নিহত
- কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত
- খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপদ পানির মারাত্মক সংকট
বিশেষ করে আবাইয়ে অঞ্চল, যেখানে ইউএনআইএসএফ মোতায়েন রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু।
মানবিক সংকট ও বেসামরিক দুর্ভোগ
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সুদানে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। হাসপাতাল, বাজার, স্কুল এমনকি ত্রাণকেন্দ্রেও হামলার ঘটনা ঘটছে।
ড্রোন ও বিমান হামলায় বহু শিশু ও নারী নিহত হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা মানবিক পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলছে।
শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
এই হামলার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে—শান্তিরক্ষীরা কি আর নিরাপদ?
বিশেষজ্ঞদের মতে,
- অপ্রচলিত যুদ্ধকৌশল
- সস্তা ও সহজলভ্য ড্রোন
- নিয়ন্ত্রণহীন সশস্ত্র গোষ্ঠী
এসব কারণে জাতিসংঘ মিশনগুলো চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা জোরদারে নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার পর বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা—
- স্বাধীন তদন্তের দাবি
- দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান
- অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির চাপ
দিচ্ছে।
জাতিসংঘ আবারও বলেছে, সুদানে টেকসই শান্তি আসতে পারে কেবল সুদানিদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি সেনারা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
এই হামলায় ছয়জন শান্তিরক্ষীর মৃত্যু শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর ক্ষতি।
তবুও বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, শান্তিরক্ষায় দেশের অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে।
সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর এই ভয়াবহ ড্রোন হামলা আবারও প্রমাণ করল—যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার হয় শান্তি ও মানবতা। ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, শান্তি রক্ষা কতটা বিপজ্জনক অথচ মহৎ দায়িত্ব।
এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কি না, আর সুদান কি আদৌ রক্তপাতের পথ ছেড়ে শান্তির পথে ফিরতে পারবে?
Related Posts
View All
🔥 চীনের দাবি অস্বীকার, অরুণাচল প্রদেশকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘোষণা | Arunachal Will Remain Integral Part”: India’s Firm Response After Shanghai Airport Detention
শেনজেন বিমানবন্দরে অরুণাচল প্রদেশের এক ভারতীয় নাগরিক আটক হওয়ার ঘটনা ভারতের কূটনৈতিক আগ্রাসনকে তীব্রভাবে সামনে এনেছে। Ministry of External Affairs স্পষ্ট জানিয়েছে, অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং চীনের কোনো দাবি বা অসন্তুষ্টি এ বাস্তবতা বদলায় না। ঘটনাটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি জাতীয় সার্বভৌম

⚠️ আবার যুদ্ধের আগুন! ট্রাম্প-মধ্যস্থ সমঝোতার পরও থাই–কম্বোডিয়া সংঘর্ষ বেড়েই চলছে | Border War Returns: Thai Airstrikes, Cambodian Artillery Shake Fragile Truce
থাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তে ফের দফায় দফায় গোলাগুলি ও বিমান হামলায় উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ট্রাম্প-মধ্যস্থ শান্তিচুক্তির মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই দুই দেশের পুরনো সীমান্ত বিবাদ আবার রক্তাক্ত রূপ নিয়েছে।






