ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী দখলের পর সৌদি-আমিরাতের যৌথ কূটনৈতিক অভিযান | নতুন সংঘাতের ইঙ্গিত?
দক্ষিণ ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ প্রতিনিধি দলের উপস্থিতি নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সংকট শুধু ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং রিয়াদ-আবুধাবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভেতরের টানাপোড়েনও স্পষ্ট করে তুলছে।

ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী দখলের পর সৌদি-আমিরাতের যৌথ কূটনৈতিক অভিযান | নতুন সংঘাতের ইঙ্গিত? - Ajker Bishshow
ইয়েমেনের দক্ষিণে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) যৌথ সামরিক প্রতিনিধি দল উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আলোচনা শুরু করেছে, যেখানে কয়েকদিন আগে প্রধান দক্ষিণ স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দেশটির বহু প্রদেশে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে।
সারসংক্ষেপ
দক্ষিণ ইয়েমেনের পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত জটিল ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত দক্ষিণ বিচ্ছিন্নতাবাদী দল সাদার্ন ট্রানজিশোনাল কাউন্সিল (STC) ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলো দখল করার পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার ও সৌদি-আমিরাত যৌথ প্রতিনিধি দলের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। এই পরিস্থিতি দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও অঞ্চলীয় নিরাপত্তা জন্য গুরুতর সংকট তৈরি করেছে।
ভূমিকা: ইয়েমেনের চলমান সংকট
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ২০১৪ সালের পূর্ব থেকেই নানা দিক থেকে জটিলভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী দেশটির উত্তর অংশে ক্ষমতা দখল করে রাজধানী সান'য়া নিয়ন্ত্রণে আনলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার দক্ষিণে বিরক্ত অবস্থায় প্রতিরোধ পায়। দীর্ঘ সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হুথিকেও মোকাবেলা করছে, কিন্তু সম্প্রতি এসব বিরোধের মধ্যে STC নামের দক্ষিণ বিচ্ছিন্নতাবাদী দল শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
এর আগে Riyadh Agreement নামের একটি শান্তি উদ্যোগ ২০১৯ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও STC-র প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল সংঘাত কমানো ও দক্ষিণ-উত্তর অংশের মধ্যে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
STC-র সম্প্রতি দখল ও রাজনৈতিক দিক
ডিসেম্বর ২০২৫ সালে STC প্রধান দক্ষিণ প্রদেশগুলোসহ Hadhramaut ও Mahra এলাকা দখল করেছে। এই দখলে অন্তত ৩২ জন সরকারি সামরিক সদস্য নিহত এবং ৪৫ জন আহত হয়েছে, যেখানে STC-সম্পর্কিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী রণসংঘাতে জড়িত ছিল বলে সরকারি সূত্রগুলি জানিয়েছে।
STC দাবি করেছে, ইতোমধ্যেই তারা দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রায় সব প্রদেশে উপস্থিত আছে, এবং এটি শুধুমাত্র সামরিক অ্যাকশন নয়; বরং রাজনৈতিকভাবে তারা একটি স্বাধীন দক্ষিণ ইয়েমেন স্থাপনের লক্ষ্যেও জোর দিয়েছে।
এই দখলে প্রধান শহর Aden-ও অন্তর্ভুক্ত হয় — যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার ও সৌদি-সমর্থিত বাহিনী তাদের মূল ভিত্তি রয়েছে।
সৌদি-আমিরাত যৌথ প্রতিনিধি দলের আলোচনার উদ্দেশ্য
সমস্যা আরও জটিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ সামরিক প্রতিনিধি দল ১২ ডিসেম্বরে Aden-এ পৌঁছেছে। দলের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে:
- দক্ষিণ ইয়েমেনের উত্তেজনা কমানো
- সম্প্রতি STC-র একতরফা পদক্ষেপ মোকাবেলা
- বাহির থেকে আনা বাহিনী বা শক্তির প্রত্যাহার নিশ্চিত করা
- পরিস্থিতি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা
- এই আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকে রাজনীতিকভাবে প্রভাবিত করে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সৌদি-আমিরাত প্রতিনিধিরা উদ্যোগ নিচ্ছেন।
সরকারি সূত্র মতে, আলোচনার মূল ফোকাস হচ্ছে STC-এর একতরফা আওতাবৃদ্ধি ও বাহিনী মোতায়েনের ঘটনাকে ঠিকঠাকভাবে মোকাবেলা করা।
সৌদি ও আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর
ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি নেতৃত্ব পর্ষদের একটি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সৌদি আরবের প্রচেষ্টা ও ভূমিকা প্রশংসা করেছেন এবং উল্লেখ করেন যে সৌদি নেতৃত্বে এই যৌথ উদ্যোগ স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পরিস্থিতি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যকার দ্বিমুখী সম্পর্কের ভেতরের টানাপোড়েনও স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে। একদিকে সৌদি সরকার দক্ষিণ ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (STC)-এর একতরফা ক্ষমতা দখল ও পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। এই দুই অবস্থানের সমান্তরাল উপস্থিতি সৌদি কূটনীতিকে এক ধরনের জটিল দোলাচল ও সংবেদনশীল ভারসাম্যের মধ্যে ফেলেছে, যা ইয়েমেন সংকট সমাধানের পথকে আরও কঠিন করে তুলছে।
দখলের প্রভাব ও মানবিক পরিস্থিতি
দক্ষিণ ইয়েমেনের দখল কেবল রাজনৈতিক ও সামরিক মাত্রায় প্রভাব ফেলছে না; মানবিক পরিস্থিতিও তদনুযায়ী খারাপ হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে স্থিতিশীলতার অভাবে অর্থনীতির ক্ষতি, সরবরাহ শৃঙ্খল ভঙ্গ, তেল ও গ্যাস সম্পদের নিরাপদ পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক নগর ও গ্রামে সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
ইউএমএনটিডির দখল ও সংঘর্ষের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে অসুবিধা, এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাহত করা হচ্ছে। এই সকল ইস্যু শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, বরং মানবিক সংকটকেও তীব্র করে তুলেছে।
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা
এই সংকট শুধু ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়; বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক মানচিত্রকেও স্পর্শ করেছে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনকে একটি স্থিতিশীল বৃহত্তর অঞ্চল হিসেবে দেখতে চায় এবং ইরানের প্রভাবকে কমাতে Houthi-সহ অন্যান্য বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় যুক্ত হয়েছে। জানা গেছে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইরান-সমর্থিত কিছু ফ্রন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে।
অপরদিকে, UAE-এর সহায়তায় উন্নত হওয়া STC দক্ষিণ ইয়েমেনের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। UAE-এর অবস্থানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দিক থেকেও দেখা হয়, বিশেষত Bab al-Mandab নৌ পথসহ সমুদ্র-সীমান্ত নিরাপত্তার দিক দিয়ে। এই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইয়েমেন সংকটে বহুপাক্ষিক প্রভাব ফেলছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও শান্তি উদ্যোগ
ইয়েমেনের এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়মিত শান্তি সমঝোতা উদ্যোগে কাজ করছে। পূর্বে Riyadh Agreement-এর মতো প্রচেষ্টা সংঘর্ষ বন্ধ ও রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃস্থাপন করার চেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছিল।
তবে সাম্প্রতিক দখলের পর জাতিসংঘ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সহযোগী দেশগুলো নতুন করে স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে জোর দিয়েছে, যাতে ইয়েমেনের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য রক্ষা পায় এবং বহুদলের আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর দখল এবং সৌদি-আমিরাত যৌথ প্রতিনিধি দলের আসা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জটিল রাজনৈতিক-মহাসামরিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। এই পরিস্থিতি শুধু ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য নয়, সমগ্র অঞ্চলীয় নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক পথের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ আলোচনার উদ্যোগ ইঙ্গিত দেয় যে, শক্তি সমন্বয় ও রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আন্তর্জাতিক actores অগ্রসর হচ্ছে। তবে বাস্তবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্থানীয় দলগুলোর সাথে মিলিয়ে কূটনৈতিক সমাধান ও দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
Related Posts
View All
🔥 সিরিয়ায় ইসরায়েলের ১,০০০+ হামলা! জোলানির বিস্ফোরক দাবি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন | Israel Launches 1,000+ Airstrikes on Syria — Jolani Drops a Bombshell
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি দাবি করেছেন যে ইসরায়েল দেশটির বিরুদ্ধে ১,০০০-এরও বেশি বিমান হামলা এবং শতাধিক স্থল অভিযান চালিয়েছে। এই অভিযোগে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

গাজায় গণবিয়ে: যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে নতুন জীবনের উৎসব | Mass Wedding in Gaza: A Celebration of New Life After Years of War and Tragedy
গাজায় বছরের পর বছর যুদ্ধ, হামলা ও মানবিক বিপর্যয়ের পর অবশেষে এক অনন্য গণবিয়ে অনুষ্ঠান আনন্দের নতুন আলো নিয়ে আসে। ধ্বংসস্তূপের শহরে মানুষের মুখে ফুটে ওঠে বহু প্রতীক্ষিত হাসি—নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি।






